নাসিরনগরে ঘরে ঘরে জ্বরের মহামারি

 

নাসিরনগর (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) প্রতিনিধি

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে ঘরে ঘরে হানা দিয়েছে ভাইরাস জ্বর। প্রচণ্ড শরীর ব্যথা, গিঁটে গিঁটে ফোলা ভাব আর তীব্র ক্লান্তি—উপসর্গগুলো অবিকল চিকনগুনিয়ার মতো। কিন্তু এটি চিকনগুনিয়া কি না, তা নিশ্চিত হওয়ার কোনো উপায় নেই। কারণ, শুধু নাসিরনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেই নয়, পুরো ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কোনো সরকারি হাসপাতালেই চিকনগুনিয়া শনাক্তকরণের পরীক্ষার কিট নেই। ফলে হাওরাঞ্চলের দরিদ্র জনপদে এক ধরনের অনিশ্চয়তা আর আতঙ্ক নিয়ে দিন পার করছেন লাখো মানুষ।

গত ২০ দিনে নাসিরনগরে ঠাণ্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় আট হাজার মানুষ। ৫০ শয্যার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটিতে প্রতিদিন ভর্তি হচ্ছেন গড়ে ১২৫ জন রোগী। রোগীর চাপে হাসপাতালজুড়ে অসুস্থ মানুষের হাহাকার। পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ যে, রোগীদের সেবা দিতে গিয়ে ক্লান্ত ও অসুস্থ হয়ে পড়ছেন চিকিৎসক এবং নার্সরাও।

সোমবার সকালে নাসিরনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে দেখা যায় এক অচেনা চিত্র। জরুরি বিভাগ থেকে বর্হিবিভাগ পর্যন্ত শুধু অসুস্থ মানুষের স্রোত। দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা ক্লান্ত শরীরগুলো যেন আর ভার বইতে পারছে না। চিকিৎসকের কক্ষের সামনে রোগীর প্রেসক্রিপশনের স্তূপ জমেছে। চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন স্বাস্থ্যকর্মীরা।

১৫ কিলোমিটার দূরের ধরমন্ডল গ্রাম থেকে এসেছেন সত্তোর্ধ্ব শরিফা খাতুন। গত দশ দিনের জ্বরে শরীর ভেঙে পড়েছে, চোখ-মুখ লাল। প্রচণ্ড ব্যথায় দাঁড়াতে পারছেন না। তাঁর সঙ্গে লাইনে দাঁড়িয়েছে দুই দিন ধরে জ্বরে কাবু তিন স্কুলপড়ুয়া নাতনি। ক্লান্ত গলায় শরিফা খাতুন বলেন, ‘গতকালও আইছিলাম ডাক্তার দেখাইতে, ভিড়ের লাইগ্যা পারি নাই। আইজকা খুব সকালে আইসা লাইনে দাঁড়াইছি, কিন্তু অহনও ডাক পাই নাই।’

শরিফার এই চিত্র এখন নাসিরনগরের প্রায় প্রতিটি পরিবারের। হাসপাতালের বারান্দায় অসুস্থ ছেলেকে নিয়ে ছয় দিন ধরে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন জুলেখা বেগম। তিনি বলেন, ‘পোলাডারে নিয়া হাসপাতালে আইছিলাম। এহন আমি আর আমার স্বামী—দুজনেই জ্বরে পড়ছি। কী করমু, কিছুই বুঝতেছি না।’

গ্রাম পর্যায়ে ১৩টি ইউনিয়নে স্বাস্থ্য সেবার অবস্থা আরো করুণ। হাওরবেষ্টিত উপজেলাটির গ্রামীণ স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতের লক্ষ্যে পর্যায়ক্রমে তিনটি উপস্বাস্থ্যকেন্দ্র, আটটি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র ও ১০ শয্যাবিশিষ্ট একটি পল্লি স্বাস্থ্যকেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়। এসব কেন্দ্রের সব ক’টি ধুঁকছে জনবল সংকটে। 

উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, তেরটি ইউনিয়নের প্রতিটি কেন্দ্রে ১৩টি মেডিকেল অফিসার (চিকিৎসক) পদের বিপরীতে একজনও নেই। একজন করে উপসহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার (সেকমো) থাকার কথা। কিন্তু একজনও নেই। পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকা থাকার কথা ১৩ জন, আছেন পাঁচজন। ১৩ জন ফার্মাসিস্ট থাকার কথা। আছেন একজন। আয়া থাকার কথা ১৩ জন, আছেন পাঁচজন। নৈশপ্রহরী থাকার কথা ১৩ জন, একজনও নেই। মোট ৯১টি পদের বিপরীতে পদায়ন আছে ২৩টিতে। আর উপজেলার ৫০ শয্যা বিশিষ্ট স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১৭৪টি অনুমোদিত পদের বিপরীতে ১২০ জনই নেই। এর মধ্যে ২৩ জন চিকিৎসকের স্থলে আছেন ৩ জন।


ধরমন্ডল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. শফিক মিয়া অভিযোগ করে বলেন, আমাদের ধরমন্ডল ইউনিয়নের স্বাস্থ্য কেন্দ্রটিতে গত ৫ বছর ধরে কোন চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়না। বছরে দুই একবার ভবনের দরজা খোলা হয়। একই অভিযোগ গোয়ালনগর. চাপরতলা, হরিপুর ও কুন্ডা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের।

নাসিরনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের তথ্যমতে, হাসপাতালে জনবল সংকট প্রকট। তার পরও ৫০ শয্যা বিশিষ্ট স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেটির বর্হিবিভাগে প্রতিদিন ৬০০ থেকে সাড়ে ৬০০ রোগী আসছেন, যার সিংহভাগই জ্বর, সর্দি, গলাব্যথা ও গিঁটে ব্যথায় আক্রান্ত। গত ২০ দিনে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছেন ২৯ জন। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, শুধু নাসিরনগর নয়, পাশের লাখাই, সরাইল, মাধবপুর ও অষ্টগ্রাম থেকেও বহু রোগী আসছেন। ভর্তি হওয়া ডেঙ্গু রোগীদের ২০ জনই অন্য উপজেলার বাসিন্দা।

রোগীর এই অস্বাভাবিক চাপ পুরো স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকেই ফেলেছে ঝুঁকিতে। আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডা. সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘হাসপাতালের অধিকাংশ চিকিৎসক ও নার্স গত কয়েক সপ্তাহ ধরে ঠাণ্ডা জ্বরে ভুগছেন। তবুও আমরা ২৪ ঘণ্টা সেবা দিয়ে যাচ্ছি। স্বল্প জনবল নিয়ে এই পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে। জরুরি ভিত্তিতে জনবল ও ওষুধ না বাড়ালে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।’

উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা (ইউএইচএফপিও) ডা. মোকবুল হোসেন বলেন, ‘বর্হিবিভাগে প্রতিদিন ৫০০-৬০০ রোগী আসছে। অনেকের মধ্যেই চিকনগুনিয়ার উপসর্গ রয়েছে। কিন্তু পরীক্ষার ব্যবস্থা না থাকায় আমরা শুধু ডেঙ্গু পরীক্ষা করেই চিকিৎসা দিচ্ছি। আমাদের চিকিৎসকরা দিনরাত এক করে কাজ করতে গিয়ে নিজেরাই অসুস্থ হয়ে পড়ছেন।’




শেয়ার করুন