১৭ বছর পর যুক্তরাজ্যে যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েন,চাপ বাড়ছে রাশিয়ার !

প্রায় ১৭ বছর পর প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্র আবারও যুক্তরাজ্যে পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েন করেছে বলে ধারণা করছেন প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকরা। এই পদক্ষেপকে ইউরোপীয় নিরাপত্তা জোরদার করা এবং রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের প্রতি একটি কৌশলগত বার্তা হিসেবেই দেখা হচ্ছে। এমন একটি সময়ে যখন ইউক্রেন যুদ্ধ ঘিরে পশ্চিমা বিশ্ব ও রাশিয়ার মধ্যে উত্তেজনা তুঙ্গে, তখন এই পদক্ষেপ বিশেষ গুরুত্ব বহন করছে বলে মনে করা হচ্ছে।


গত ১৬ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের নিউ মেক্সিকোর আলবুকারকি শহরে অবস্থিত একটি পারমাণবিক অস্ত্রঘাঁটি থেকে একটি সামরিক পরিবহনবিমান ব্রিটেনের লেকেনহিথ ঘাঁটির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। বিমানটি যাত্রাকালে নিজের পরিচয় ও অবস্থান প্রকাশ করে উড্ডয়ন করে, যা সাধারণত পারমাণবিক অস্ত্র পরিবহনের সময় দেখা যায় না। বিশ্লেষকদের মতে, এই ঘটনাটি ইচ্ছাকৃত এবং রাশিয়ার প্রতি বার্তা পাঠানোর কৌশল হিসেবে গ্রহণযোগ্য হতে পারে।


সামরিক পর্যবেক্ষকরা জানিয়েছেন, এই বিমানটি ‘প্রধান পারমাণবিক পরিবহন ইউনিট’-এর অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং এটি সাধারণত কেবলমাত্র পারমাণবিক অস্ত্র পরিবহনের ক্ষেত্রেই ব্যবহৃত হয়ে থাকে। বিমানের উড্ডয়ন রুট এমনভাবে নির্ধারণ করা হয় যাতে তা কোনো তৃতীয় দেশের আকাশসীমা অতিক্রম না করে সরাসরি যুক্তরাজ্যে পৌঁছাতে পারে। এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র তাদের কৌশলগত সংবেদনশীলতা ও গোপনীয়তা বজায় রেখেছে বলেও ধারণা করা হচ্ছে।


যদিও যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্য উভয় দেশই তাদের পারমাণবিক অস্ত্র কোথায় মোতায়েন করা হয়েছে, তা প্রকাশ করে না, তবে মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের বাজেট দলিলে দেখা গেছে, লেকেনহিথ ঘাঁটিতে পারমাণবিক অস্ত্র সংরক্ষণের জন্য গত কয়েক বছর ধরে নিরাপত্তা অবকাঠামো উন্নয়নের লক্ষ্যে কোটি কোটি ডলার ব্যয় করা হয়েছে। এই বিনিয়োগ থেকেই ধারণা করা হচ্ছে, সেখানে নতুন প্রজন্মের পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েনের প্রস্তুতি অনেক আগেই শুরু হয়েছে।


বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, যুক্তরাজ্যে মোতায়েন করা এই অস্ত্রগুলো হতে পারে বি৬১-১২ মডেলের পারমাণবিক বোমা, যেগুলো উন্নত প্রযুক্তির সাহায্যে নির্ভুলভাবে নির্ধারিত লক্ষ্যে আঘাত হানতে সক্ষম। এছাড়া এই অস্ত্রগুলো ‘ভ্যারিয়েবল ইয়িল্ড’ অর্থাৎ তীব্রতা অনুযায়ী সামঞ্জস্যযোগ্য, যা যুদ্ধক্ষেত্রে কৌশলগত সুবিধা নিশ্চিত করতে পারে। ঠান্ডা যুদ্ধের পরে এই প্রথমবার ইউরোপে যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক অস্ত্রের সংখ্যা ও উপস্থিতি এভাবে বাড়ানো হলো।





এদিকে ইউরোপীয় নিরাপত্তা বিশ্লেষক উইলিয়াম আলবেরকে বলেন, উড্ডয়নকালে ট্রান্সপন্ডার (পরিচয় সংকেত) চালু রেখে বিমানটির যাত্রা পরিচালিত হয়েছিল, যা সাধারণত গোপনীয় সামরিক পরিবহনে দেখা যায় না। এই পদক্ষেপ যুক্তরাষ্ট্র ইচ্ছাকৃতভাবে নিয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে, যার মাধ্যমে রাশিয়াকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, ইউরোপে তাদের পারমাণবিক সক্ষমতা কোনোভাবে হ্রাস পায়নি, বরং তা নতুনভাবে সাজানো হয়েছে।


যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক পারমাণবিক তথ্য প্রকল্পের পরিচালক হ্যান্স ক্রিস্টেনসেন বলেন, যুক্তরাষ্ট্র যে যুক্তরাজ্যে আবার পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েন করেছে, সে বিষয়ে এখন পর্যন্ত সরাসরি সরকারি স্বীকৃতি না এলেও বিভিন্ন শক্তিশালী তথ্য-উপাত্ত থেকে এই বিষয়ে জোরালো ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। তিনি বলেন, পারমাণবিক অস্ত্র পরিবহনের ক্ষেত্রে এমন প্রকাশ্যতা সাধারণত উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে একটি বার্তা প্রেরণ করতেই এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে থাকে।


তিনি আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপ নিঃসন্দেহে ন্যাটোর প্রতিরোধ নীতি আরও শক্তিশালী করবে এবং ভবিষ্যতে এমন আরও পদক্ষেপ দেখা যেতে পারে। পারমাণবিক অস্ত্র যুক্তরাজ্যে ফিরিয়ে আনা কেবল প্রতীকী সিদ্ধান্ত নয়, এটি ইউরোপের নিরাপত্তায় একটি বাস্তবিক ও কার্যকর পদক্ষেপ।


অন্যদিকে আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিশ্লেষক সিদ্ধার্থ কাউশাল মনে করেন, এই মোতায়েন রাশিয়ার থিয়েটার-স্তরের পারমাণবিক অস্ত্রের বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের প্রতিরোধ শক্তিকে ভারসাম্যপূর্ণ করতে সহায়তা করবে। ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলে রাশিয়ার সামরিক সক্ষমতা ক্রমাগত বেড়ে চলেছে এবং এর জবাবে ন্যাটোর কৌশলগত প্রস্তুতিও দিন দিন উন্নত হচ্ছে।


এই প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রের এমন পদক্ষেপ বিশ্ব নিরাপত্তা কাঠামোয় বড় ধরনের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। ইউক্রেন যুদ্ধ ঘিরে পশ্চিমা সামরিক জোট ও রাশিয়ার মধ্যে উত্তেজনা যেভাবে বাড়ছে, তাতে করে ভবিষ্যতে এমন পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন।


তবে এই পদক্ষেপ শান্তির পথকে কতটা সুগম করবে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। কিছু পর্যবেক্ষক মনে করেন, এর ফলে ইউরোপে নতুন করে অস্ত্র প্রতিযোগিতার ঝুঁকি তৈরি হতে পারে, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে পুরো অঞ্চলের স্থিতিশীলতার ওপর। তবে একথা সত্য যে, বিশ্বশক্তিগুলো তাদের ভূরাজনৈতিক অবস্থানকে শক্তিশালী করতে কোনো কিছুই হাতছাড়া করছে না।


শেয়ার করুন